কলঙ্কিনী ১ম+২য়_পর্ব
স্বামী বিদেশে রয়েছে তিন বছর আর তুই গর্ভবতী হয়েগেলি কিভাবে? কলঙ্কিনী বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। তোকে তো এই বুকে জায়গা দিয়েছিলাম, কিন্তু তুই কিভাবে এমন নষ্টামি করতে পারলি? আমার ছেলে আজকে তিন বছর বিদেশে আছে। আর তুই নিজের পেট বাধিয়ে বসে আছিস?”
শ্বাশুড়ি সারার গালে চড়ের উপর চড় লাগাতে লাগাতে কথা গুলো বলল।
কিন্তু ওর যে উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই। কি জবাব দেবে ও?
যেই মানুষটা তাকে বুকে ঠাই দিয়েছিলো তার সাথেই তো বেইমানি করা হয়েছে।
“বল তোর পেটে এই পাপ কার? আমাদের খেয়ে আমাদের পড়ে কার পাপ তুই নিজের গর্ভে ধরে রেখেছিস?”
নাসরিন বেগম সারার চুল ধরে কথা গুলো বলল
“তুই বল, কোন জিনিসের অভাব রেখেছি আমি বল তুই? তুই কি সুখি ছিলি না? জবাব দে আমাকে? এতো বড় অন্যায় কিভাবে করলি?”
নেহা তার মাকে শান্ত করারা চেষ্টা করছে কিন্তু নাসরিন বেগম কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছেনা। যেই মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে এনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, কোনো আশ্রিতার পরিচয়ে না, নিজের ছেলের বউ হিসেবে। কিন্তু এই হতবুদ্ধি টা কি করে বসলো এটা ভেবেই নাসরিন বেগমের দুঃখ,কষ্ট, ঘৃণা সব এক সাথে হচ্ছে।
এই কারনেই হয়তো সবাই বলে রাস্তার জিনিস রাস্তায় ফেলে আসাই শ্রেয়। তারা বড় জায়গা পেলেই কি করে নিজেরাই ঠিক পায়না।
সারা নাসরিন বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ও মা! আমিতো অন্যায় করেছি। তুমি যদি আমাকে তাড়িয়ে দাও তাহলে আমি এখন কোথায় যাবো। আমার শেষ ঠিকানা যে তুমি।”
নাসরিন বেগম সারা কে পা থেকে উঠিয়ে দাড় করিয়ে আবার ওর গালে দু চারটা চড় লাগায়।
“তোর মুখ খানা দেখলে ঘৃনায় আমার বমি আসছে। তোকে মাফ করবো কিভাবে? কলঙ্কিনী, আমার ছেলেটা বিদেশে গিয়েছে কার জন্য? আরে হতভাগী, সে তো তোর জন্যই পাড়ি জমিয়েছে বাইরে। যাতে করে তোদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। কিন্তু তুই একি করলি? কার পাপ পেটে ধরলি”
পাশের বাড়ির মালিহা বলে
-কাকিমা আমি কয়দিন আগে দেখেছি। একটা লোক জানালা দিয়ে সারা ভাবির ঘরে প্রবেশ করে। আমি তখন বিষয়টা বুঝতে পারিনি বা আমার মাথায় এই জিনিসটা কাজ করেনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি।
ভাবির পেটের বাচ্চার বাবা তাহলে সেই লোকটা।
নাসরিন বেগম ফোনটা হাতে নিয়ে ছেলের কাছে কল দেয়।
আমান কলটা ধরে,
-মা, তুমি কেমন আছো? প্রেশার কেমন এখন?
নাসরিন বেগম ছেলের কথা শুনে হাওমাও করে কেদে ফেলে। কি বলবেন তিনি তার ছেলেকে? তোর বউয়ের পেটে অন্যের সন্তান?
এসব ভাবতে ভাবতে নাসরিন বেগমের ব্লাড প্রেসার হাই হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমান। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই আর পড়াশোনা করা হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে, আসলে ওড় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ একটু কম ছিলো। বাবার বেশ কয়েক বিঘা জমি থাকায় চাষবাসের কাজে লেগেছিলো।
কিন্তু কয়েক বছর পর নতুন আবদার করে বসে মায়ের কাছে। সে বিদেশে কাজ করতে যাবে।
নাসরিন বেগম বেশ কয়েকবার বারণ করেছিলো যে,
-বিদেশে গিয়ে তুই কি করবি? আল্লাহ আমাদের জমি জমা তো আর কম দেয়নি। তুই চাষ কর।
-না মা, তুমি জানোনা আজকে বাইরের দেশে কাজে গেলে কত মুল্য। কত কত টাকা আয় করা যায়।
-কিন্তু….
-কোনো কিন্তু করোনা মা। আমি তো বেশিদিন থাকবো না। মাত্র পাচ বছর ওখানে থাকবো। তারপর আবার চলে আসবো।
এখানে এসে একটা বড়সড় ব্যাবসা করবো।
নাসরিন বেগম শেষমেশ রাজি হয়। কিন্তু একটা শর্ত জুড়ে দেয় যে, যাওয়ার আগে বিয়ে করে যেতে হবে।
ভাগ্যক্রমে সারার সাথে দেখা হয়। মেয়েটা অনাথ ছিলো। নাসরিন বেগমের খুব দয়া হয় ওকে দেখে।
২য় কিছু চিন্তা না করেই ছেলের বউ করে ফেলে সারাকে। সারা যেমন মিষ্টি মেয়ে তেমন তার ব্যবহার।
কিন্তু একি করে ফেললো?
, নাসরিন বেগম ফোন কানে ধরে এসব ভেবেই যাচ্ছে। ওপাশ থেকে ছেলেটা কথা বলেই যাচ্ছে সেটা তার খেয়ালের বাইরে চলে গেছে।
হঠাৎ মনে হলো ছেলে কিছু বলছে,
-মা তুমি কাদছো কেন, কি হয়েছে তোমার? বাড়িতে কি কেও নেই? আমাকে বলো কি হয়েছে? সবাই ঠিক আছে তো? বাবা ঠিক আছে তো?
নাসরিন বেগম আচল দিয়ে নিজের মুখ চেপে রেখেছে। কান্নাটা থামানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই কান্না বন্ধ করতে পারছেনা।
-বাবা রে আমাকে মাফ করে দিস। আমাকে মাফ করে দিস। আমি মা হয়ে তোকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছি।
-কোনো বিপদে ফেলেছো মা? বিদেশে তো আমি নিজ ইচ্ছাই এসেছি। তাছাড়া আমি তো সুখেই আছি বিপদ কিসের?
-তোকে বিয়ে দিয়ে আমি সর্বনাশ ডেকে এনেছি। এই বাড়িতে কালনাগিনীর আশ্রয় দিয়েছি। যাকে বউমা কম মেয়ে বেশি ভেবেছি সে আজকে অন্যের পাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। এই কষ্ট আমি কোথায় রাখবো। তুই আমাকে মাফ করে দে বাবা।
-মা, হয়েছেটা ক আগে বলবেতো?
-তোর বউ নতুন মরদ ধরেছে। তার পেটে এখন অন্যের বাচ্চা।
মায়ের কথা শুনে আমান চুপ হয়ে গেল। এই কথার কোনো উত্তর যে ওর কাছে নেই।
নাসরিন বেগম আবার বললেন,
-চুপ করে আছিস কেন? কিছু তো বল। এই পাপিনীকে আমি কি করবো বল? ইচ্ছা তো করছে ওকে জ্যান্ত পুতে ফেলি মাটিতে। আয়ায়ায়া।
-মা, ম, মা কি হয়েছে তোমার? কথা বলছো না কেন মা?
নাসরিন বেগম ছেলের সাথে কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
চলবে….
#পর্ব০২
সারা তাড়াতাড়ি করে নাসরিন বেগমের কাছে গিয়ে মাথাটা কোলে তুলে নেয় আর বলে,
-মা কি হয়েছে তোমার? মা তুমি আমাকে কলঙ্কিনী বল, অন্য কিছু থাকলে সেটাও বলো, আমার মুখে লাথি মারো। কিন্তু আমাকে দুরে সরিয়ে দিও না। কথা বলো মা!
নেহা সারা কে ধাক্কা মেরে দিয়ে মায়ের মাথাটা নিজের কোলের উপরে নিয়ে বলল,
-ভাবি তোমাকে তো বোনের আসনে বসিয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি এটা কি করলে? ভাইয়ার ভালোবাসা, আমাদের বিশ্বাস সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ কিভাবে করে দিতে পারলে?
তোমার ঐ মুখ দেখলেও আমার ঘৃণা হচ্ছে, জাস্ট ঘৃণা হচ্ছে।
সারা কাদতে কাদতে বলল,
-নেহা এমন বলো না। আমার শুরুও তোমরা আর শেষও তোমরা।
-ও শুরু আমরা আর শেষটাও আমরা মাঝখান দিয়ে তুমি অন্যকারো। তার শয্যসাথী। আমার কি ইচ্ছা করছে জানো তো! তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর কে খাইয়ে দিতে ইচ্ছা করছে।
-নেহা!!!
-তোমার ঐ পাপি মুখে আমার নামটা নিওনা দয়া করে। তোমার মুখে নিজের নামটা শুনলে আমার সারাদেহ গুলিয়ে উঠছে।
-আমি কি এতোটাই পাপিষ্ঠা?
-তুমি কতটা পাপিষ্ঠা সেটা জানো না? তুমি কি বুঝতে পারছো কতটা পাপিষ্ঠা তুমি?
-নেহা বোন আমার, আমার কথাটা একটু শোনো। মাকে একটু ধরতে দাও।
সারা হাওমাও করে কাদতে লাগলো। এমন ভুল ও কিভাবে করে ফেললো নিজেই বুঝতে পারছেনা। এই সমাজে সে এখন স্বীকৃতি প্রাপ্ত কলঙ্কিনী।
– না না তোমার কোন কথাই শোনা হবে না।
আমার মা যদি মরেও যায় তবে তোমার হাতের স্পর্শ আমার মাকে পেতে দেবো না।
তোমাকে হাতজোড় করে বলছি তোমার ওই পাপীষ্ঠ মন পাপীষ্ঠ দেহ নিয়ে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।
আজ মাকে তুমি নাহয় অজ্ঞান দেখছো কালকে আমাকে তুমি গলায় দড়ি দিতে দেখতেও পারো।
তোমার মত কলঙ্কিনী মেয়ের সাথে একই ছাদের নিচে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
সারা কাদতে কাদতে কথা বলার অবস্থাতে নেয়। তবুও কষ্ট করে বলল,
-না না আমার মত পাপিষ্ঠা কলঙ্কিনীর কারনে তুমি কেন আত্মহত্যা করবে। তার চেয়ে আমি বরং এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তুমি ঠিকই তো বলেছো নষ্টা একটা মেয়েকে নিয়ে এক বাড়ি এক ছাদের নিচে আসলেই থাকা যায়না। আমি বাড়ি থেকেই চলে যাচ্ছি আর কখনো আসবো না।
আমার মত কলঙ্কিনী কে নিয়ে আর কোন কথা শোনা লাগবে না তোমাদের।
নাসরিন বেগম এর মাথা নেহার কোলে আর সারা ঠিক তারই পাশে বসে আছে সারার শেষ কয়েকটা কথা নেহার একেবারেই সহ্য হয়না। ওর যেন মনে হয় সারা ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে।
তাই রাগে রাগে সারা গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয়
বয়সে ছোট একটা মেয়ের হাতে সারা চড় খেয়ে একটুও অবাক হল না সারা, কারণ এটাই যে ওর প্রাপ্য ছিল। পাপের ফল ভোগ করাই লাগবে।
নেহা প্রতিবেশি দুইএক জনের সাহায্য নিয়ে নাসরিন বেগম কে।
খাটের উপর শুইয়ে দেয়।
সারা এখনো চুপ করে বসেই আছে একই জায়গাতে। শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। চোখদুটো যেন কোনো ঝরনা ধারা হয়ে গেছে থামার নামই নেই।
আজকে এই বাড়িতেই শেষ দিন সারার ভাবতেই বুকের ভিতর মোচড় মেরে ওঠছে। যে মানুষটা সারাকে সম্মানের সাথে ঘরে তুলেছিলো তিনিই আজকে ছি ছি করে বিদায় করে দিচ্ছেন।
নিয়তি বড়ই অদ্ভুত কখন কার সাথ দেয় কার সাথে বেইমানি করে কেও জানেনা। আজকে নিয়তির কাছে পরাজিত হয়েগেছে সারা। পাপের ফল ভোগ করতেই হবে।
নিজের সমস্ত কাপড়চোপড় গোছগাছ করে অন্তিম বিদায়ের জিন্য নাসরিন বেগম আরা নেহার কাছে গেল।
-নেহা আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো। মাকে ভালো করে দেখে রেখো। মা যেন কোনো চিন্তা না করে।
যেন ভাবে আমি একটা বাষ্পীয় পদার্থ সময়ের সাথে সাথে আকাশে মিলিয়ে গেছি।
নেহার খুব ইচ্ছা করছে প্রিয় ভাবিকে বুকে জড়িয়ে নিতে, কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কাছে সে আজকে বাধা পড়ে গেছে। সারার দিকে ভালো দৃষ্টিতে তাকানোর ইচ্ছা হলেও মস্তিষ্ক বলে দিচ্ছে৷ ও নষ্টা মেয়ে।
নেহাকে চুপচাপ থাকতে দেখে সারা বলল,
-আমাকে একটা বার মাকে ছুয়ে দেখতে দিবে না নেহা?
নেহা সহজ গলায় বলল,
-না।
সারা শেষ বারের মত নিজের সংসার, নিজের স্বর্গ দেখে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। হাতে একটা ব্যাগ আছে। তাতে হয়তো কয়েকটা পোশাক।
গন্তব্যহীন ভাবে হেটে চলেছে সারা কোথায় যাবে, কার কাছে সাহায্য চাইবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। আজকে সারার হাটার কোনো শেষ হবেনা। শুধু আজকে কেন হয়তো সারাজীবন এমন ছন্নছাড়া হয়েই কাটিয়ে দিবে।
সন্ধ্যার দিকে, সারা মেইন রোডের ধার দিয়ে হেটে চলেছে। খুব কষ্ট করে হাটছে কিন্তু দেহ দুর্বল হওয়ার কারণে যখন তখন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে।
পাশ কাটিয়ে একটা গাড়ি যাওয়ার সময় দাড়ালো।
-আপু আপনার কি কোনো হেল্প লাগবে?
-না আমি ঠিক আছি।
আমানের বাড়িতে, রাত ৮ টার দিকে নাসরিন বেগম কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছে। নেহা থালা থেকে ভাত আর ডাল দিয়ে মাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।
নাসরিন বেগম খাবার মুখে নিতে গিয়েও নিতে পারলো না। আবার সেই কান্না শুরু করে দিলো।
-নেহা মা, বলতো ওকে কিসের অভাবে রেখেছিলাম। ও এটা কি করলো। আমাদের বিশ্বাসকে নিয়ে এভাবে খেলা করতে পারলো কিভাবে?
-মা যে গেছে তার চিন্তা বাদ দাও। তুমি খেয়েনাও তো।
-নেহা।সারা এখন কোথায় আছে? ওর কোনো খোজ পেয়েছিস?
-মা, ঐ কালনাগিনী বিদায় হয়েছে ভালোই হয়েছে। ও জাহান্নামে যাক তুমি ওর জন্য চিন্তা কেন করবো।
নেহা আর নাসরিন বেগম কথা বলছিলো এমন সময় পাশের বাড়ির কনিকা নেহাদের বাড়িতে এসে বলল,
-নেহাপু টিভিতে দেখো কি খবর হচ্ছে? চমকে যাবে তুমি।
নেহা টিভি অন করার সাথে সাথেই সত্যি চমকে উঠলো কারণ, খবরে বলছে, ‘সারা নামের একজন মেয়ে আর তিন পুরুষকে অনৈতিক কাজের জন্য গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ’। নেহা খপ করে টিভিটা বন্ধ করে দেই।
-ছিহ, শেষমেশ ঐ পাপিষ্ঠার খারাপ কাজের জন্য পুলিশ ধরলো? ছিহ।
রাগের পিছনে সারার জন্য নেহার মনে যেই ভালোবাসাটা ছিলো সেটা একনিমিষে শেষ হয়ে গেল। হ্যা সত্যি, খবরে দেখানো মেয়েটা নেহার ভাবি সারা ই ছিলো।পরের পর্ব গুলো পোস্ট করার সাথে সাথে পেতে
এই পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন
,চলবে
লেখনীতেঃ মেহবুব
Comments
Post a Comment