বিধবা মহিলা পর্ব ২ (শেষ পর্ব )
Part-2 ( শেষ পর্ব)
- খুব ঠান্ডা পড়েছে। পিনপতন নীরবতার মাঝে হঠাৎ আমার কানে ভেসে আসল করুণ ফোঁপানির আওয়াজ। বুঝতে পারলাম আয়েশা পাশের রুমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি তোয়াক্কা না করে শুয়ে পড়লাম।
চোখ খুলতেই হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন বদ্ধ স্থানে। কিছুই দেখতে পারছিনা আমি। উঠে দাড়াবার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছেনা। হঠাৎ আলোকিত হয়ে গেল ঘরটা। আমার সামনে আমি আবিষ্কার করলাম এক বিরাট আয়না। আয়নাতে প্রতিফলিত হচ্ছে একটা ছোট্ট বাচ্চার ছবি। একি, এতো আমিই! এটাতো আমার ছোটবেলার ছবি! আমি হঠাৎ এত ছোট কি করে হয়ে গেলাম? চরম রকমের ভয় পেয়ে গেলাম আমি। কাঁদতে লাগলাম চিৎকার করে। হাত পা ছুড়ছি, কিন্তু উঠে দাড়াতে পারছি না ; কাদছি আর অস্পষ্ট কিছু উচ্চারণ করছি, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছি না। হঠাৎই ঘরটার আদল বদলে গেল। নিজেকে আবার আবিষ্কার করলাম সেই ঘরে, যে ঘরে একসময় আমি, মা আর বাবা থাকতাম। আমি বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুড়ে কাঁদছি। কিন্তু চারপাশে কেউ নেই। হঠাৎ দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করল মা বাবা। তাদের দেখে আমি চমকে গেলাম। মা আমাকে কোলে তুলে নিল। মা আমাকে দোলাচ্ছে, আর বাবা আমাকে হাসানোর চেষ্টা করছে। বাবার আজগুবি কান্ড দেখে আমি হাসতে লাগলাম। বাবাকে দেখে আমি প্রচন্ড রকমের খুশি হই, বলতে ইচ্ছা করছিল " বাবা, বাবা তুমি এসেছো! কতদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি আমি। তুমি বলে আকাশের তারা হয়ে গেছিলে। কিন্তু কই, এইতো আমার সাথে তুমি। আর ছেড়ে যেওনা আমায় প্লিজ। "
টপ করে একফোটা পানি আমার চোখ বেয়ে নেমে পড়ল।
হঠাৎই সবকিছু আবার বদলে গেল। আমি আবার চলে আসলাম সেই অন্ধকার স্থানে। এ কি হচ্ছে আমার সাথে। আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম; আর মনে মনে বাবাকে ডাকতে লাগলাম, মুখ দিয়ে কথাই বলতে পারছিনা যে! অন্ধকারের মাঝে আলোর রেশ ছিটিয়ে হঠাৎ এক মানব অবয়ব ফুটে উঠল। দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে। একটা মুচকি হাসিমাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি হাত বাড়িয়ে বাবাকে ছোয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। ছোটবেলায় এক অজানা ঝড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর আর চোখের দেখা হয়নি। আজ তাকে দেখে কতটা তৃপ্তি হচ্ছে বলে বোঝানো অসম্ভব। আমি হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে চলেছি বাবার দিকে, কিন্তু ততটাই দূরে সরে যাচ্ছে তার অবয়ব। আমি ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। পানিতে চোখ টইটুম্বুর হয়ে গেছে। বাবার একবার ছোয়া পাওয়ার জন্যে আমি কাতর। কিন্তু তা কিছুতেই সম্ভবপর হচ্ছেনা। হঠাৎ আলোর তীব্রতা কমতে লাগল। বাবা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো দূরে। আমি হাত বাড়িয়ে আছি। 'বাবা' অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। আবার অন্ধকার পরিবেশকে গ্রাস করে নিল। কালো অন্ধকারের মাঝে ছোট্ট আমি বুক ভরা হাহাকার নিয়ে বসে আছি। চোখও যে এখন দেখি পর হয়ে গেল। পানি ঝরাচ্ছেনা। একেক করে বাবার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু যখন মনে পড়ছে সব অতীত, তখন হৃদয়টা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সব দুঃখ কষ্ট ভেতরেই জমে জমে পাহাড় তৈরি করছে, কিন্তু এক ফোটাও কষ্ট বের হতে পারছেনা।
লাফিয়ে উঠলাম আমি। ঘেমে গেছি একেবারে। চারপাশে তাকিয়ে নিজেকে নিজের রুমেই আবিষ্কার করলাম। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলাম। নিজের বালিশের দিকে তাকালাম। ভিজে নাজেহাল হয়ে গেছে। তখনি আমি শুনতে পারলাম কোনো বাচ্চার " আপ, আপ, আপ " আওয়াজ। আমি নিচের দিকে তাকালাম। দেখি রাহিমার মেয়ে নিশি বসে বসে খেলছে, আর উল্টাপাল্টা কিছু বলছে। আমি বিছানা ছেড়ে নিচে দাড়ালাম। হাটু গেড়ে বসলাম নিশির সামনে। ও হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এতদিনে ওর চেহারাও ভাল করে দেখিনি। আজ দেখে বুঝলাম খুব সুন্দর মেয়েটা। ওর চোখগুলো খুব মায়াবী। হঠাৎ আমার মনে পড়ল যে মেয়েটারও তো বাবা মারা গেছে! মেয়েটা যখন বুঝতে শিখবে তখন তার ভেতরেও আমার মত হাহাকার কাজ করবে৷ আমি বুঝি বাবা না থাকার কষ্ট, একদিন এই বাচ্চা মেয়েটাকেও বুঝতে হবে। ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে দুফোটা জল চোখ বেয়ে নেমে পড়ল। হঠাৎ নিশি তার হাত বাড়িয়ে আমার মুখে উপর রাখল। তার স্পর্শে আমি ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। নিশি তার ছোট্ট আর কোমল হাত দিয়ে আমার চোখে পানি মুছে দিল। আর মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দে উচ্চারণ করল," বা…বা "
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। এ আমি কি করছিলাম এতদিন? এমন একটা ফুটফুটে পরীর মত বাচ্চা মেয়েকে আমি দূরে দূরে রাখছিলাম। ও তো আমারই মেয়ে। এমন একটা মেয়ে পেয়েছি এটা আমার জীবনের অনেক বড় একটা প্রাপ্তি। কজন এমন মেয়ে পায়? আমার চোখ দিয়ে অঝোরে খুশির জোয়ার বইতে লাগল। কোলে তুলে নিলাম নিশিকে। কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম,
" সরি মা, সরি। তোকে এতদিন খুব কষ্ট দিয়েছি। আর দিবনা। তুই আমার মেয়ে মা, তুই আমারই মেয়ে। আরেকবার বাবা বল। "
মেয়েটা আবার অস্ফুট শব্দে উচ্চারণ করল, " বা…বা "
আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করল আমার মনে। এই বোধহয় বাবা হওয়ার আনন্দ। নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম ভাগ্যবান ব্যক্তি মনে হচ্ছে। এমন সময়ে হঠাৎ শুনতে পেলাম রহিমার ডাক, " নিশি, নিশি "। নিশিকে খুজছে সে। খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে সে আমার রুমের সামনে চলে এলো। নিশিকে আমার কোলে দেখে প্রচন্ড আতংকিত হয়ে গেল সে। দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো নিশিকে আমার কোল থেকে। মাথা নিচু করে ভিজে গলায় বলতে লাগল,
" দয়া করে ক্ষমা করে দিন। আর কখনো ওকে আসতে দেবনা ওকে। ক্ষমা করে দিন।"
কথাটা বলেই আচলে মুখ লুকিয়ে নিশিকে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল রহিমা। যাওয়ার আগে ওর চোখে আমি জল দেখতে পেয়েছিলাম। হয়তো সে ভেবেছে আমি নিশিকে বকা বা মারার জন্য কোলে তুলে নিয়েছি। নিজের উপর চরম ঘৃণা হতে শুরু করল। এতদিন কি করছিলাম আমি! আমি এতো নিকৃষ্ট কি করে হলাম। রহিমা তো আমার স্ত্রী, ওকে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম আমি! মেয়েটার কি দোষ? ও তো এখনো বাচ্চা মেয়ে। বিয়ের দু তিন বছর পরই তার স্বামী মারা গেল। সে স্বামীর সুখও ঠিকভাবে পায়নি। মায়ের কাছে শুনেছিলাম তার স্বামী নাকি বেশ একটা ভাল ছিলনা। শুধু তার দেহই চাইত, মনের দিকটা বিবেচনা করত না। আমিও তো তার মত পশু হয়ে গেলাম। নাহ, রহিমা আমার স্ত্রী। ওকে ওর প্রাপ্য ভালবাসা আমি দিব। ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। মেয়েটা খুব সহজ সরল। আমার না করার পর তাকায়ও নি আমার দিকে। আমাকে খুব ভয় পায়। আমি আমার ভুলে এতদিনে বুঝতে পারলাম। আমি ছুটে গেলাম রহিমার রুমের দিকে। বাইরে থেকে কাঁদার আওয়াজ আসছে। কতটা কষ্টই না তাকে দিয়েছি আমি। আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে এখন। আমি আস্তে করে দরজা খুললাম। দরজা খুলে দেখলাম রুমের এককোণে রহিমা নিশিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে যাই তার সামনে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি ওকে। ও প্রথমে অনেক ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু ঘুরে যখন আমায় দেখে তখন ভয়ের চেয়ে অবাক বেশি হয়,
" আ…আ…আপনি! "
" হ্যাঁ আমি। আমাকে প্লিজ মাফ করে দেও রহিমা। "
" কি বলছেন আপনি এসব? আপনি কি করেছেন? "
" আমাকে তুমি প্লিজ ক্ষমা কর। এতদিন তোমাদের সাথে আমি খুব অন্যায় করেছি। " আমার চোখে পানি দেখে হতভম্ব হয়ে যায় রহিমা।
" আমার কি কোনো বড় ভুল হয়ে গেছে যে এভাবে বলছেন? আমাকে মারার জন্যে এভাবে ধরেছেন? ভুল হয়ে গেলে মেরে শোধ তুলতে পারেন। "
আমি হেসে দিলাম।
" ধুর পাগলি। কেউ কাউকে মারার জন্য কি জড়িয়ে ধরে? "
" তাহলে কেন ধরেছেন? "
" নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরার অধিকার নেই আমার? আমি কি আমার স্ত্রীকে ভালবাসতে পারিনা? " মুচকি হাসি দিয়ে বললাম আমি।
এবার ভূত দেখার মত চমকে উঠল রহিমা।
" রহিমা, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমাদের আমি খুব কষ্ট দিয়েছি এতদিন। কিন্তু আর না। তুমি আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী ; আর নিশি আমার মেয়ে, আমার সব। "
কেদে দিল রহিমা। এতটা বোধহয় কোনোদিন আশা করেনি সে।
" আমি… আমি কি স্বপ্ন দেখছি? বলুন না প্লিজ। "
" আরে নাহ। এটা বাস্তব। আর আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি, এটাও বাস্তব। "
" আমি… আমি… এতটা ভাগ্যবতী! আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। "
আমি রহিমার কপালে চুল গুলো সরিয়ে একটা আলতো করে চুমু দিলাম।
" আর হ্যাঁ, আর আপনি না কিন্তু। এবার থেকে তুমি করে বলবে। "
খুশিতে কেঁদে দিল রহিমা। ও আমাকে জাপটে ধরল।
" জানো, এইদিনের জন্য কত অপেক্ষা করেছি আমি। তোমায় অনেক ধন্যবাদ। "
" এটা তোমার প্রাপ্য, রহিমা। আমার তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, যে তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে। "
সেদিন প্রায় সারাটা দিন আমি নিশি আর রহিমাকে জড়িয়ে ধরে গল্প করেছি। রাতের বেলা আমরা একই রুমে শুলাম। রহিমার এখনো সবটা বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমার বুকের উপর মাথা দিয়ে রহিমা উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আছি।
" রহিমা, শুনো। "
" বলো। "
" চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে কেউ আমাদের চিনবেনা। "
" কেন? " রহিমা আমার মুখের দিকে ফিরে তাকাল।
" আমি চাইনা আমাদের মেয়ে জানুক যে আমি তার দ্বিতীয় বাবা। যদি কোনোদিন জানতে পারে, তবে সে হতাশায় ভুগতে পারে; নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা, দুর্ভাগ্যবান মনে করতে পারে; আমার কাছে আসতে ইতস্তত বোধ করতে পারে; সে কষ্ট পেতে পারে। আমি সেটা চাইনা। কিন্তু এ সমাজে থাকলে কোনো না কোনো ভাবে সে জেনেই যাবে সত্যটা। তাই চলো আমরা দূরে কোথাও নতুন করে আমাদের জীবন শুরুকরি। অন্তত আমাদের মেয়ের খাতিরে সবকিছু শুরু থেকে গড়ব আমরা। "
" হুম ঠিক বলেছ। আমরা যাব। "
সেদিন রহিমা আর নিশিকে বুকে করে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক শান্তি লেগেছিল সেদিন।
এরপর আমরা কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করে চলে যাই। একটা বার্তা ছেড়ে যাই সবার জন্য, না খোঁজার জন্য অনুরোধ জানিয়ে৷ কিন্তু মায়ের মায়া তো আর কাটাতে পারবনা৷ মা তো অনন্য, তার স্থান আরও উর্ধ্বে। তার সাথে সম্পর্ক, যোগাযোগ সবই অটুট ছিল ও থাকবে। আমাদের মর্জিতে হারিয়ে যাওয়া দেখে আর কেউ খোঁজার চেষ্টাও করেনি। পৃথিবীর অন্য এক কোণায় নিজেদের জীবন গড়তে লাগলাম আমরা।
১০ বছর পর....
আমি স্বপ্ন দেখছি,
সেই মুহুর্তটা, যখন আমি নিশিকে প্রথম কোলে তুলে নিয়েছিলাম। সে প্রথম আমাকে বাবা ডেকেছিল, আমার চোখের জল মুছে গিয়েছিল। পুরনো স্মৃতি স্বপ্নে দেখে খুশির জল আবারো আমার চোখের কোণা দিয়ে বেয়ে পড়তে লাগল। হঠাৎ কারোর কোমল স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখলাম নিশি আমার চোখের জল মুছে দিচ্ছে। ঠিক সেদিনের মত। কিন্তু আজ ও বড় হয়েছে। নিশি বলতে লাগল,
" বাবা, কাদছ কেন? "
" না মা, এমনি। বুকে আয় মা। "
নিশিকে বুকে টেনে নিলাম। আমার পাশে রহিমা শুয়ে ছিল। ওকেও টেনে নিলাম।
" আমি খুব ভাগ্যবান রে, মা। "
" কিভাবে, বাবা? "
" তুই বুঝবিনা। আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান। একজন ভাগ্যবান পিতা। "
খুশির জল চোখে ভাসিয়ে অদূর স্বপ্নের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। তবে আজ আমি একা নই। আমার সাথে আছে আমার দুই পরী। দুইটা জগৎ।
ভাগ্যবান
এবার অবশ্যয় একটা লাইক দেওয়া জেতে পারা বন্ধুরা ।
Comments
Post a Comment