নিনিত_যুদ্ধ (পর্ব ১)

 একদিন পর,  নিখোঁজ হওয়া  মামাতো বোন রিফাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় , একটা ব্রিজের নিচে অচেতন অবস্থায় পেলাম ।  অর্ধনগ্ন বলার কারণ , রিফার শরীরের জামাকাপড় ঠিকঠাক নেই । ছেড়া এবং কিছুই ঠিক নেই । গত পড়শু দিন থেকে রিফাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । রিফা অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । খুব সাদামাটা এবং খুব ভালো মনের একটা মেয়ে ।  ওর সাথে এত খারাপ কিছু হবে তা কখনও কল্পনা করিনি ।  রিফা নিখোঁজ হওয়ায় মামী অসুস্থ হয়ে পড়েছে । মামা সেই কবেই পটল তুলেছে । সংসারের সকল দেখাশোনা মামী নিজে একা হাতে করেন ।   পরিবারের বাবা একজন খুটি স্বরূপ । রিফাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে । রিফার অবস্থা খুব একটা ভালো না । টেনশনে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।  রক্ত লাগবে , ঔষধ লাগবে ইত্যাদি সব আমার করা লাগছে । আমি ছাড়া এসব করার মতো আপাতত কেউ নেই । নিজের কাজ ফেলে রেখে অন‍্যর কাজ করে দেওয়ার মতো মানুষ পৃথিবীতে এখন বিরল । 

আমি হসপিটালে ওয়েটিং রুমে বসে থেকে সময়  পার করি । কখন কি লাগে ম‍্যানেজ করি । গত তিনদিন ধরে চোখে ঘুম নেই ।  এক প্রকার ঘুমানোর সময়ই পাচ্ছি না । সময় পেলেও ঘুম হবে না । কি থেকে কি হয়ে গেল আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না ।রিফা  সকালে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলেও দুপুরে আর বাড়ি আসেনি। প্রতিদিন দুপুরেই বাড়ি ফিরে আসে । অন‍্য কোথাও যাওয়ার প্রোগ্রাম থাকলে সেটা বাড়িতে অবশ্যই বলে যায় । কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা হলো তবুও রিফা বাড়ি ফিরলো না । মামী চরম টেনশন করতে লাগলো । রাত আটটা নাগাদ আমি খবরটা জানতে পারি । ততক্ষণে সকল আত্মীয় বাড়ি খোঁজ নেওয়া শেষ । এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা ছাড়া আমাদের হাতে আর কিছু থাকে না । পুলিশকে ইনফর্ম করলেও কোনো লাভ হবে না। পুলিশ চব্বিশ ঘন্টার আগে কোনো নিখোঁজ ব‍্যক্তির জন্য   সুবিধা দেন না । তাদের মতবাদ , লোকটা হয়তো আত্মীয় বাড়িও যেতে পারে অথবা এমন কোনো পজিশনে আছে যে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার কোনো সময় পাচ্ছে না।হয়তো কিছুক্ষণ পরেই সে ফোন করে বলবে , 

-আমি ওমক জায়াগা আছি , আসতে একটু লেট হবে অথবা কোনো এক বন্ধবীর বাসায় থাকবো ।  আর যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে তো আমরা আমাদের কাজ করবোই ! 

আমি সহ কয়েকজন , বিশেষ করে মামীও থানায় গিয়েছিল । পুলিশের এমন কথায় , মামী ওই ইয়াং পুলিশ অফিসারের পায়ে ধরে বলল 

-স‍্যার আমার মেয়েটাকে এনে দেন ।  ও ছাড়া আপন বলতে  আমার আর কেউ নেই ।  

মামী অবশেষে কেঁদেই ফেললেন ।কয়েকজন পুলিশও কেঁদে দিলেন । কারো কষ্টে যদি আমাদের মনে কষ্ট না লাগে তবে আমাদের কষ্টেও অন‍্যদের কষ্ট লাগবে না ।  

ওই ইয়াং পুলিশ অফিসার মাথা থেকে টুপি খুলে মামীকে  বলল

-আপনি শান্ত হোন । আমরা যথা সাধ‍্য চেষ্টা করবো। এমনকি ডিউটি বাদেও আমরা আপনার মেয়েকে খুঁজতে থাকবো । 

পুলিশ অফিসারের কথায় অনেকটুকু আশ্বাস পেলাম ।সব পুলিশ এক না । সকল পুলিশই দেশের জন্য এক একটা সোনার দ্বীপ । 

রিফার প্রেমিক আছে এমন নজির আমার চোখে কখনও পড়েনি । রিফার এমন গোপন শত্রু আছে এটা হয়তো রিফা জানেই না । 

রিফাকে খুঁজে পেয়ে আর পুলিশকে ইনফর্ম করিনি । শুধু শুধু নিজেদেরকে ছোট করার কোনো মানে হয় না । 

রিফাকে বাড়িতে আনা হলো । রিফা শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ । সারাদিন রুমটা অন্ধকার করে বসে থাকে । রুম থেকে বের হয় না । কারোর সাথেই কথা বলে না ।  রিফার এমন অবনতি দেখে মামী শুধু চোখের জল ফেলে ।   

রিফার এই অঘটনের পর থেকে প্রতিদিনই ওদের বাড়িতে যাওয়া হয় । 

আমার মা ছিল নানুর একমাত্র মেয়ে । আর মামা ছিল একমাত্র ছেলে । মা আর মামার মাঝে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল । কিন্তু ঈদানীং মা কেমন যেন মামীদের কথা শুনতেই পারে না । যদি মামীদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলি , মা কেমন তেজে উঠেন । 

অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার একটু পরে বের হচ্ছিলাম । মা তখন বলল

-রোজ রোজ তোর ওই বাড়িতে যেতে হবে কেন ?

আমি মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । কোনো প্রতিউত্তরে গেলাম না । বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছেন ।  মা আমাকে ফলো করে , আমার খবর নেয় , এটা আমি বুঝতে পারলাম । কোনো কথা না বলে বাসা থেকে বের হলাম । 

রাত নেমেছে অন্ধকারে 

কেউ জ্বেলেছে শলোক,

শত মানুষ নিদ্রায় আছে 

কারো চোখে পড়ে না পলক । 

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বাক্য দুটো মনের মাঝে উকি দিল । কথা তো সত‍্যই ।  মানুষ জনম বোঝা বড় কষ্ট । আমি হাঁটছি রিফার বাড়ির উদ্দেশ্যে । ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত । রাস্তায় নিয়ন আলো নেই। এই রাস্তায় কোনো আলো নেই । কেন নেই আমি জানিনা । আমার ইচ্ছাও হলো না আলো না থাকার কারণটা জানতে । আমি হাঁটতে শুরু করলাম আগের মতোই । ফিনফিনে বাতাস বয়ে যাচ্ছে পূবে । রাস্তার আশেপাশের বাড়ি থেকে গুনগুন করে ছোট ছেলেমেয়েদের পাঠ‍্য বই পড়ার ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে । আমি মুখরিত শব্দে মাতাল হয়ে হাঁটছি । আমার কিছু সময়ের জন্য ছোট বেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো । ছোটদের মতো করে জোরে জোরে বই পড়তে ইচ্ছা হলো । পাঠ‍্য বই । 


রিফার বাড়িতে ঢুকে দেখি মামি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন । চোখের কোনো বেদনার জল । সারাদিনে একবার হলেও আমিই এই বাড়িতে আসি । আর কেউ আসে বলে মনে হয় না । মামী আমাকে দেখে এগিয়ে এলো । চোখের জল মুছে কিছু বলতে চাইলো , কিন্তু পেরে উঠলো না । হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো । আমি আশ্বস্ত করার ভাষা হারিয়ে ফেললাম । অজান্তেই আমার চোখে জল জমতে শুরু করলো । আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম

-কিছু খেয়েছেন ? 

মামী ভাঙা গলায় বলল

-ওকে রেখে খাই কি করে ! সারাদিনে কিছুই মুখে তুলে না ।  

-আপনি শান্ত হোন আমি দেখছি । 

এক প্লেঠ খাবার নিয়ে রিফার রুমে ঢুকলাম ।  রুমে ছিটে ফোটাও আলো নেই । আবছায়া দেখলাম কেউ একজন দেওয়ালে  পিঠ ঘেসে বসে আছে ।ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিতেই রিফা আমার দিকে তাকালো ।

 আমাকে দেখে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না ।  

রিফার সামনে বসে বললাম

-কিরে কিছু খাচ্ছিস না কেন ? এভাবে চলতে থাকলে তো মরে যাবি । 

রিফা মুখ ফিরিয়ে বসলো । আমি আবার বললাম

-কি হলো তোর ? দেখ যা হয়েছে সব ভুলে যা । মনে কর তোর জীবনে গত কয়েকটি দিন ছিল না । দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে । রিফা চোখ মুছে নিবির গলায় বলল

-সব কিছু চাইলেই কি সহজে ভোলা যায় ? কিছু জিনিস তো বারবার মনের গহীনে বসে থাকে । 

রিফা তাচ্ছিল্য করে হাসলো । হাসতে হাসতে হাতের নকের দিকে তাকিয়ে বলল

-আমি তো মরেই গেছি । নতুন করে আর কি মরবো !   আমার বেঁচে থাকার আত্মা মরে গেছে । তাই বেঁচে থাকা আমার জন্য একটা যুদ্ধ ।  

আমি আশাহত কণ্ঠে বললাম

-দেখ , পাগলামি করিস না । জীবনের এখনও কিছুই শেষ হয়নি । সবে শুরু । 

-একটা নারীর সতীত্ব হরণের চেয়ে বড় ক্ষতি তার জীবনে আর কিছু থাকতে পারে না । এরপরও যদি তুমি বল , কিছু হয়নি তবে তুমি ভুল । তোমার ভাবনা ভুল । 

রিফা একটু থেমে আবার বলল

-আমার বিয়ের বয়স হয়নি এমন না । অনেক সম্বন্ধও এসেছে । তুমি কি বলতে চাও এর পরেও আর কোনো সম্বন্ধ আসবে ? না আসবে না । কারণ এলাকায় খারাপ খবর রটিয়ে দেওয়ার মানুষের অভাব বিরল ।  

আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম

-তুই কি কাউকে চিনতে পেরেছিস ?  

-না । 

-আচ্ছা , এখন খেয়ে নে । 

রিফা কুটম্বিক করে বলল

-আমার একটা কথা রাখবে ? 

-হ‍্যা বল । 

রিফা একটু চিন্তিত হয়ে বলল

-তুমি আর আমাদের বাড়িতে আর এসো না । লোকে খারাপ বলবে । তুমি না আসলে আমি খাবো সব ঠিকঠাক করবো । 

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল । আমি ভাতের প্লেট রেখে উঠে দাঁড়ালাম । একটু দাঁড়িয়ে বললাম

-কোনো উল্টা পাল্টা কিছু করিস না ।  

রিফা আবার হাসলো । হেসে বলল

-আত্মহত্যা মহাপাপ ! আর যাইহোক আমার থেকে এটা কখনোই হবে না । 


সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে বসলাম । মা কাঁচের গ্লাস পানি খেয়ে বলল

-রিফা আত্মহত্যা করেছে । ইচ্ছা হলে  ও বাড়ি যেতে পারিস ।  

মায়ের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো । আমার মাথায় কিছুতেই বিষয়টি যাচ্ছে না । এতবড় ঘটনার পরও মা স্বাভাবিক আছে কিভাবে ।  মনে পড়লো রিফার বলা কথাটা । আমি রিফার বাড়ির উদ্দেশ্যে তটস্থ হয়ে রওনা দিলাম । রিফার বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা জটলা । লোকের ভির ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম । ভিতরে যেয়ে আমার চোখ কপালে উঠলো ! মামীকে একটা মাদুরে শুয়ে রাখা হয়েছে । রিফা পাশে বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে । আমিও ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম । আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না , মা আমাকে মিথ্যা বলল কেন ? মারা গেছে তো মামী ! তাহলে মা আমাকে রিফার কথা কেন বলল? 

চলবে...


নেক্সট পার্টগুলো সবার আগে আইডিতে দেওয়া হবে নীল লেখায় চাপ দিয়ে সবাই আইডি ফলো করুন 👉 উন্মুক্ত লাইব্রেরী

Comments

Popular posts from this blog

পিচ্ছি কালের গুন্ডি বউ (পর্ব:-১ )

একটা রিকশাওয়ালার গল্প ( পর্ব ১ )

বিধবা মহিলা পর্ব ২ (শেষ পর্ব )