পরিবার
নতুন স্ত্রীকে নিয়ে টেবিলে খেতে বসেছি। টেবিলে আরো আছে বাবা মা ভাই বোন। স্ত্রী সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলো। খানিক পর আমি সবার প্লেটে মাছ তুলে দিতে লাগলাম। বাবা মা ভাই বোনের প্লেটে মাছ তুলে দেয়ার সময় কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু স্ত্রীর প্লেটে যেই মাছ দিলাম, দেখলাম কলেজ পড়ুয়া ছোটো বোনটা ফিক করে হেসে দিলো। ভার্সিটি পড়ুয়া ছোটো ভাইটাও মুচকি হাসলো। বাবার চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠলো। মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালো। আর স্ত্রী বিব্রত হয়ে পড়লো।
খাওয়া শেষে রুমে এসে স্ত্রী বললো,"বাসার মানুষদের সামনে তুমি কখনো আমার প্লেটে খাবার তুলে দেবে না।"
অবাক হয়ে বললাম,"তুমি সবার সামনে আমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে পারবে, সেটাতে কোনো সমস্যা হবে না, আর আমি দিলে সমস্যা হবে? এটা কেমন নিয়ম?"
"আমাদের সমাজের এটাই নিয়ম। দয়া করে সবার সামনে আমাকে আর বিব্রত কোরো না। আড়ালে এসব নিয়ে হাসাহাসি হয়, মন কষাকষি হয়।"
পরদিন খাওয়ার টেবিলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দিলাম না। তবে স্ত্রী যখন সবার প্লেটে খাবার দেয়ার পর আমার প্লেটে খাবার দিচ্ছিলো, আমি তখন স্ত্রীকে বললাম,"আমাকে দিতে হবে না। আমি নিজে নিতে পারবো। তুমি নাও।"
সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, ছোটো বোনটা আবারো ফিক করে হেসে দিলো। ছোটো ভাইটাও মুচকি হাসলো। বাবার চেহারায় আবারো অস্বস্তি দেখা দিলো। মায়ের চোখ আবারো হয়ে উঠলো তীক্ষ্ণ। আর স্ত্রী হয়ে গেলো আবারো বিব্রত।
খাওয়া শেষে রুমে এসে স্ত্রী কিছু বলার আগেই বললাম,"কথা দিচ্ছি খাওয়ার টেবিলে তোমাকে আর কিছু বলবো না। তোমাকে আর বিব্রত করবো না।"
স্ত্রী বললো,"তুমি আমার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছো, আমাকে খাবার নিতে বলছো, এতে আমি খুশি হই। কিন্তু আমাদের সমাজের নিয়ম হলো, স্ত্রী স্বামীর সেবা করবে। এর উল্টো হলে শুরু হয়ে যাবে হাসাহাসি, বদনাম।"
পরদিন থেকে স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দেয়া কিংবা স্ত্রীকে খাবার নিতে বলা বন্ধ করে দিলাম। এতে অন্যদের হাসাহাসি, অস্বস্তি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
আমি তখন এর সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলাম। ভেবে দেখলাম, সমাধানের পথ দুটি। এক. বাবা মা ভাই বোনের সাথে না খেয়ে নিজের রুমের ভেতর স্ত্রীকে নিয়ে খেতে হবে। দুই. আলাদা বাসা নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে হবে।
বাবা মা'র সাথে থেকে প্রথমটা করা সম্ভব নয়। এটা করলে আমি আর স্ত্রী দুজনই প্রশ্নবিদ্ধ হবো। একমাত্র পথ হলো, আলাদা হয়ে যাওয়া।
রাতে স্ত্রীকে বললাম আলাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়টা। স্ত্রী শুনে নাকচ করে দিলো।
বললো,"মা আমাকে পছন্দ করে বউ করে এনেছেন। মাকে ফেলে অন্য কোথাও যেতে পারবো না।"
"মাকে যদি রাজি করাতে পারি তাহলে যাবে?"
"সামান্য একটা ব্যাপারের জন্য আলাদা হয়ে যাবো?"
"এটা সামান্য ব্যাপার না। দেখবে এরপর আরো বহু সমস্যা তৈরি হবে।"
স্ত্রীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের রুমে গেলাম।
তারপর একথা সেকথা বলার পর মাকে বললাম,"মা, অফিসে কাজ বেশ বেড়ে গেছে। সামনে থেকে কলিগরা অফিসের কাজে আমার বাসায় আসবে। এতে তোমাদের সমস্যা হবে। এজন্য ঠিক করেছি, আমি আলাদা বাসা নেবো। মা, আমার আলাদা হবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু অফিসের কাজের জন্য আলাদা হতে হচ্ছে।"
মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ভারী গলায় বললো,"মিথ্যা বলা শিখতে তোর এখনো সময় লাগবে। আমি শুধু জানতে চাই, আলাদা হয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটা কার, তোর না তোর স্ত্রীর?"
মায়ের ভারী গলা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। তাই দোষটা স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দিলাম।
বললাম,"স্ত্রীর।"
ঐ মুহূর্ত থেকে মা আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। স্ত্রীর রান্না করা খাবার খায় না। নিজে রান্না করে খায়। স্ত্রী পরিষ্কার বুঝতে পারলো মা কোনো কারণে তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কী কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছে তা বুঝতে পারলো না। বেচারি বিনা দোষে কষ্ট পেতে লাগলো। এবং নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। তার খাওয়া দাওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো।
স্ত্রীর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন মাকে বলে দিলাম আলাদা হয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটা স্ত্রীর ছিলো না, আমার ছিলো। স্ত্রী বরঞ্চ আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা শুনে না করে দিয়েছিলো।
মা একথা শোনার পর ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মারলো।
এবং বললো,"তোর আহাম্মকির জন্য আমিও কষ্ট পেলাম, মেয়েটাও কষ্ট পেলো।"
এই বলে মা আমার রুমে গেলো। এবং স্ত্রীকে পুরো ব্যাপারটা বলে বললো,"আহাম্মকটার জন্য আমরা শুধু শুধু কষ্ট পেলাম। এসো, আমরা মা মেয়ে একসাথে খাবো।"
মা এবং স্ত্রীর একসাথে খাওয়ার দৃশ্যটি দেখে এতো ভালো লাগলো যে, চড় খাওয়ার কষ্টটা ভুলে গেলাম।
রাতে ঘুমানোর সময় আনন্দ নিয়ে স্ত্রীকে বললাম,"এখন থেকে তো বাসার মানুষদের সামনে তোমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে পারবো, তাই না?"
স্ত্রী বললো,"না।"
না শুনে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। কী করে সমাজের এই নিয়মটা ভাঙবো বুঝতে পারলাম না।
প্রতিদিন সবাই মিলে খেতে বসতাম। স্ত্রী সবার প্লেটে খাবার তুলে দিতো। এক সময় আমিও সবার প্লেটে খাবার তুলে দিতাম। শুধু স্ত্রীকে ছাড়া। স্ত্রীকে রেখে বাকিদের খাবার দিতে কী যে খারাপ লাগতো!
একদিন খাবার টেবিলে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেলো। আর তাতেই সম্ভব হলো, সমাজের নিয়মটা ভাঙা।
বাবা সেদিন সবার সামনে আচমকা এক টুকরো মাংস মায়ের প্লেটে তুলে দিলো। আমার জীবদ্দশায় বাবাকে কোনোদিন মায়ের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দেখি নি। স্বাভাবিক কারণে মা তাই ধাক্কার মতো খেয়ে বাবার দিকে তাকালো। মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে আমাদের খাওয়া থেমে গেলো। মা কী বলে শোনার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অবশেষে মা মুখ খুললো।
বেদনার্ত কণ্ঠে বাবাকে বললো,"গত ৩৩ বছর সংসার জীবনে আমি শুধু তোমার প্লেটে খাবার তুলে দিলাম, তুমি একদিনের জন্যও আমার প্লেটে খাবার তুলে দিলে না! এজন্য আমাকে ৩৩ বছর অপেক্ষা করতে হলো?"
বলতে বলতে মা'র চোখে পানি চলে এলো।
বেশ কিছু সময় কেউ কোনো কথা বললো না।
এক সময় বাবা মায়ের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভেঙে সবার উদ্দেশ্যে বললো,"স্ত্রী স্বামীর প্লেটে খাবার তুলে দিলে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ ওটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দিলে অনেকে অনেক কিছু মনে করে। কারণ সমাজের চোখে ওটা অস্বাভাবিক ঘটনা। তবে আমি চাই এখন থেকে এই ঘরে স্বামীর স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দেয়াটাও হবে স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ এটা নিয়ে কোনো কথা বলবে না।"
তারপর অপরাধী এবং অনুতপ্ত স্বরে আমাকে বললো,"তোর মা ৩৩ বছর ধরে যে দুঃখ পেয়েছে, আমি চাই না বউমাও ৩৩ বছর ধরে সে দুঃখ পাক।"
আমি আর দেরি করলাম না, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললাম,"নিশ্চয়ই।"
ঠিক তখন জানালা দিয়ে একটা প্রজাপতি উড়ে এলো। খুব সুন্দর দেখতে। আমি জানি, বাবার মনটা এখন ঐ প্রজাপতির মতোই সুন্দর হয়ে উঠেছে। হয়তো আমার মনও। আমাদের পুরুষদের মন ঐ প্রজাপতির মতোই আজীবন সুন্দর থাকুক।
ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করে দেবেন 🙏
Comments
Post a Comment